মেসি ক্ষণজন্মা। গড গিফটেড। যুগে যুগে তাদের মতো খেলোয়াড়দের আবির্ভাব ঘটে না। আবির্ভাব ঘটে ধূমকেতুর মতো। যেমন আবির্ভাব ঘটেছিল পেলে, তারপর ম্যারাডোনা এখন মেসি। পেলে, ম্যারাডোনার হাতে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফি শোভা পেয়েছে। কিন্তু মেসির হাতে তা শোভা পায়নি। এটি আবার মেসির শেষ বিশ্বকাপ। রিক্ত হস্তে ফিরবেন ফুটবলের খুদে জাদুকর? সৃষ্টিকর্তাও হয়তো তা চাননি। তিনি যেন গোল আর নৈপুণ্যের ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন মেসিদের জন্য। মরুর বুকে আকাশের চাঁদ হয়ে থাকা বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফি উঠেছে মেসির হাতে। তবে এমনিতেই আসেনি টানটান উত্তেজনার ম্যাচ নির্ধারিত সময় দুই দুই গোলে অতিরিক্ত সময়ে তিন-তিন গোলে ড্র থাকার পর গড়ায় টাইব্রেকারে।
সেখানে তারা ফ্রান্সকে হারায় ৪-১ গোলে। আর্জেন্টিনার হয়ে মেসি, দিবালা, পারডেস, মন্টিয়েলন গোল করলেও ফ্রান্সের হয়ে এমবাপে ও কোলো মুয়ানি গোল করেন। কোযমেনের শট ইমি মার্টিনেজ ঠেকিয়ে দেন টিচুয়ামেনির শট বাইরে দিয়ে চলে যায়। আর্জেন্টিনার এটি ছিল তৃতীয় শিরোপা। সর্বশেষ তারা শিরোপা জিতেছিল ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার নেতৃত্বে।
একে একে মেসি চার চারটি বিশ্বকাপে সফল হতে পারেননি। এবার শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু যিনি গড গিফটেড, তার হাত রাঙাতে সৃষ্টিকর্তা যেন একটু বেশিই পরীক্ষা নিতে চাইলেন। বিষয়টি এমন, তোমাকে যখন সব দিয়েছি। বিশ্বকাপও বাকি রাখবো না। এটাও দেব। তবে এতো সহজে না। একটু বেশি পরীক্ষায় ফেলে, টেনশনে রেখে, তারপর।
তাই বলে এমন পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় পড়ে শিরোপাই হাত ছাড় হওয়ার উপক্রম। ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে ২-২ গোলে সমতা। দুই গোল পরিশোধের পর ফ্রান্স এমনভাবে আর্জেন্টিনাকে চেপে ধরেছিল, তাতে করে তৃতীয় গোল বের করে নেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল না। তারপর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও আবার মেসির গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে যায়। পরে আবার ফ্রান্স গোল পরিশোধ করে। এবারও গোল পরিশোধের পর আবারও ফ্রান্স ঝড়। যে ঝড়ে আবারও আর্জেন্টিনার রক্ষণ কেঁপে উঠেছিল। তারপরই না খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানেই বিধাতা সব লিখে রেখেছিলেন।
একটি ফাইনার যে রকম হওয়ার কথা ছিল তার সবই এসে হাজির হয়েছিল। দুই দলের সেরা দুই খেলোয়াড় মেসি ও এমবাপের দিকে নজর ছিল সবার। দুই জনের মাঝে আবার ছিল গোল্ডেন বুটের লড়াইও। দুই জনই হতাশ করেনি। মেসি করেছেন দুই গোল। এমবাপে করেছেন হ্যাটট্রিক। গোল্ডেন বুট জিতেছেন তিনিই। কিন্তু তার হ্যাটট্রিক আড়ালে পড়ে গেছে মেসিদের শিরোপা জয়ের পথে। মেসি জিতেছেন গোল্ডেন বল। গোল্ডেন গ্লাভস জিতেছেন আর্জেন্টিনার গোরক্ষক ইমি মার্টিনেজ। তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কারও গিয়েছে আর্জেন্টিনার শিবিরে। পেয়েছেন এনজো হার্নান্দেজ।
ফাইনাল যে এমন উত্তেজনার মসলা মাখিয়ে শেষ হবে তা কিন্তু খেলার ৮০ মিনিট পর্যন্ত ছিল না। এ সময় প্রথমর্ধে মেসি ও ডি মারিয়া গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে ছিল। দুই গোলে এগিয়ে থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনা কিন্তু রক্ষণাত্মক পদ্ধতি অবলম্বন করেনি। কারণ এভাবে দুই গোলে এগিয়ে থাকার পরও ফাইনালে খেলার সমতা আনার নজির তাদের বিপক্ষে অতীতে আছে। ১৯৮৬ সালে জার্মানির বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর জার্মানি খেলার সমতা এনেছিল। পরে বুরচাগার গোলে আর্জেন্টিনা জিতেছিল ৩-২ গোলে। তাই এবার দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আর্জেন্টিনা ছিল আক্রমণাত্মক। ফলে ফ্রান্সের চেয়ে এই অর্ধেও তারা সুযোগ তৈরি করে বেশি। ফ্রান্সকে শুধু বলের জন্য এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। এসময় আর্জেন্টিনা বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগ সৃষ্টি করে গোল না পাওয়াটা ছিল রীতিমতো হতাশ জনক। ৬০ মিনিটে ডি মারিয়ার কাছ থেকে বল পেয়ে বক্সের ভিতর থেকে মেসির ডান পায়ের শট সাইট বার ঘেঁষে বাইরে চলে যায়। তিনি সঠিকভাবে শট নিতে পারেননি রাবিউট বাধা দেওয়ার কারণে। ৬৪ মিনিটে মেসির কাছ থেকে বল পেয়ে আ্যলিস্টার শট নেওয়ার আগে গোলরক্ষক বাধা দিয়ে নিশ্চিত গোল রক্ষা করেন। এ সময় পর্যন্ত ফ্রান্স একটি মাত্র শট বারে নিতে পেরেছিল। আর কর্ণার পেয়েছিল একটি।
আর্জেন্টিনার দাপটের মধ্য দিয়েই খেলা গড়ায় ৮০ মিনিটে। তখন আর্জেন্টিনার দর্শকরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ান উৎসব শুরু করে দিয়েছেন। বিবিসি লাইভে বুয়েন্স আয়ার্সে ম্যারাডোনার বাড়ির সামনে আর্জেন্টিনার সমর্থদের একটি ছবি দিয়েও সংবাদ পরিবেশন করে। এ ছাড়া বিবিসি লাইভেও বারবার উল্লেখ করা হচ্ছিল আর্জেন্টিনার সমর্থকদের এখন পার্টি করার সময়। এ রকম ধারনা অমূলক ছিল না। কারণ তখন পর্যন্ত খেলায় ফ্রান্সকে খোঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না।
কিন্তু হঠাৎ করে ফ্রান্স ঘুরে দাঁড়ায় এক মিনিটের ব্যবধানে দুই গোলই পরিশোধ করে। ৮০ মিনিটে বক্সের ভিতরে অটামান্ডি বদলি খেলোয়াড় কুলু মুয়ানিকে ফাউল করলে রেফারি পেনাল্টি দেন। পেনাল্টি থেকে এমবাপে গোল করে মেসির সমান ছয় গোল করে মেসির সমান গোলদাতার তালিকা উঠে আসেন। পরের মিনিটেই এমবাপে আবারো গোল করে খেলা সমতা আনেন। তার গোলটে ছিল দর্শনীয়। মাঝমাঠে কাজ থেকে বল কেড়ে নিয়ে সেই বল পরে তোরাম ও বাপের আদান প্রদান করে পরে বক্সের ভিতর থেকে এমবাপে ডান পায়ে তীব্র শটে গোল করে আনেন সমতা আনেন। সেই সঙ্গে সাত গোল করে টপকে যান মেসিকে। হয়ে যান একক সর্বোচ্চ গোলদাতা।
এ সময় ফ্রান্স খেলার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর্জেন্টিনাকে বেশ চেপে ধরে। দুইটি গোল পরিশোধ করা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি সুযোগ নষ্ট করে। এ সময় তারা এমনভাবে খেলছিল যে কোনও মুহুর্তে তৃতীয় গোল পেয়ে যেত। কোনঠাসা হয়ে পড়া আর্জেন্টিনা ইনজুরি টাইমে মেসির বক্সের ভেতর থেকেবাম পায়ের তীব্র শট গোলরক্ষক লরেস ঝাঁপিয়ে পড়ে নিশ্চিত গোল রক্ষা করলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
১০৪ মিনিটে আর্জেন্টিনা সুযোগ নষ্ট করে উপর্যপুরি। প্রথমে বদলি লাউতারো মার্টিনেজের শট ফ্রান্সের রক্ষণভাগের একজন খেলোয়াড় ফিরিয়ে দেয়ার পর বদলি আরেক খেলোযাড় মনিটয়েলের ফিরতি শটে আবারও ফ্রান্সের রক্ষণের একজন খেলোয়াড় হেড করে রক্ষা করেন। ১০৭ মিনিটে মেসির বাম পায়ের শট লরেস ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করেন। ১০৮ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে গড়ে উঠা আক্রমণকে সফল পরিণতি আসে মেসির মাধ্যমে। অ্যালেস্টারের শট লরেস ফিরিয়ে দিলেও সামনে দাঁড়ানো মেসি আলতো টোকায় বল জালে জড়িয়ে দৌড় শুরু করেন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল অফসাইড। কিন্তু রেফারি গোলের বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ১১৮ মিনিটে ফ্রান্স সেই গোল আবার পরিশোধ করে পেনাল্টি থেকে এমবাপের মাধ্যমে। এমবাপের শট আর্জেন্টিনার রক্ষণের একজন খেলোয়াড়েন অনিচ্ছাকৃতভাবে হাতে লাগলে রেফারি পেনাল্টি দেন। এই গোল করে এমবাপে মেসিকে ছাড়িয়ে গোল্ডেন বুটের একক মালিক বনে যান আট গোল করে। শেষ মুহুর্তে ইমি মার্টিনেজ নিশ্চিত একটি গোল রক্ষা করেন। পাল্টা আক্রমণ থেকে লাউতারো মার্টিনেজর হেড বারের বাইরে দিয়ে চলে গেলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। তারপর রচিত হয় মেসির আর্জেন্টিনার ইতিহাস।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মির্জা সাইফুল ইসলাম, ঠিকানা: দারুল মুসাফির ( নিচ তলা ) আব্দুল গণি হেড মাস্টার রোড, সদর, লক্ষ্মীপুর।