নজরুল কেন বহুমাত্রিক? সাধারণত আমাদের কাছে নজরুল বিদ্রোহী কবি এবং সাম্যবাদের কবি হিসেবে পরিচিত। কেননা আমরা জানি নজরুল গেয়েছেন,
“গাহি সাম্যের গান-মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”
আবার নজরুলের ঐ একই মুখ থেকে বিদ্রোহী চেতনার ঝঙ্কার বেজে উঠেছে,
“ মহা – বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-“
এতেই কিন্তু নজরুল বহুমাত্রিক নন। এ ছাড়াও নজরুল হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বাঙালি। যিনি সাহিত্য ও সংগীতের মাধ্যমে একটি জাতিকে জাগিয়ে তোলেন। ঔপনিবেশিক শাসন শোষণে নজরুল ছিলেন রণতুর্য। নজরুল রচনাবলীতে আমরা দেখি তাঁর দ্রোহের পরেই রয়েছে মানব প্রেম। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক সংহত রূপের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সকল দল মতের উপরে মানবের অস্তিত্বকে দেখতে চেয়েছেন। অত্যাচারীকে বিনাশ করে সত্য সুন্দর পৃথিবী ছিলো নজরুলের কামনা।
এ রকম অসংখ্য পরিচয়ে নজরুল বহুমাত্রিক। কবি নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ব্যতীত কোনো কবি নেই, যারা বাংলা সংগীতে এতো বেশি অবদান রেখেছেন। গানের সংখ্যায় নজরুল রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি তাঁর সীমিত কর্মজীবনে ৩০০০/৫৬০০ এরও বেশি গান রচনা করেছেন। এ সকল নজরুলগীতি ১০টি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলোঃ ভক্তিমূলক গান, প্রণয়গীতি, প্রকৃতি বন্দনা, দেশাত্মবোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যাঙ্গাত্মক গান, সমবেত সঙ্গীত, রণ সঙ্গীত এবং, বিদেশীসুরাশ্রিত গান। একক ভাবে এতো গান রচনার কৃতিত্ব আর কোনো দেশে নজরুলের মতো সংগীতজ্ঞ পাওয়া যায় না।
নজরুল অগ্নিবীণা হাতে বাংলা কাব্যে প্রবেশ করেছেন। তিনি বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়ছেন, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্য জগতের পালাবদল ঘটে। তাঁর কবিতায় বিশেষ ভাবে প্রকাশ পেয়েছে বিদ্রোহী চেতনা, সাম্যবাদী চেতনা, এবং মানব প্রেম।
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হলে নজরুলের কাব্যিক প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক। তাই নজরুলকে উদ্দেশ্য করে কবিগুরু আশীর্বাণী দিয়েছেন,
“আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন!
অলক্ষণের তিলকরেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে’
আছে যারা অর্দ্ধচেতন!”
নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা, ফনীমনসা, চক্রবাক, সাতভাই চম্পা, নির্ঝর, নতুন চাঁদ, মরুভাস্কর, সঞ্চয়ন, ইত্যাদি
গদ্য রচনাতেও নজরুলের অসাধারণ কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যে তিনি প্রথম পত্রোপন্যাস “বাঁধনহারা” রচনা করেন। এ ছাড়া আরো দুটি উপন্যাস রচনা করেছেন, “মৃত্যুক্ষুধা ও কুহেলিকা।” মৃত্যুক্ষুধা বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটি।
এছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম ৬ টি নাটক রচনা করেছেন। নাটকগুলোর নাম ঝিলিমিলি, আলেয়া, পুতুলের বিয়ে, মধুমালা, ঝড়, পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে।
প্রবন্ধ রচনায় নজরুল ছিলেন সপ্রতিভ। তিনি ঔপনিবেশিক শোষণ মেনে নেননি। তাই তো প্রথম লিখিত ভাবে নজরুল তাঁর “ধূমকেতুর পথ” প্রবন্ধে লিখেছেন,
“একটিমাত্র টুকরো ভারতীয় ভূমি
বিদেশীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না।”
তার প্রবন্ধগুলো ৫ টি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। সে গুলো হলো, যুগবানী, ঝিঙ্গে ফুল, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র মঙ্গল, ধুমকেতু।
ব্রিটিশ সরকার নজরুলের ৩টি প্রবন্ধ গ্রন্থ সহ মোট ৭ টি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করেন।
এছাড়া নজরুল অনুবাদ সাহিত্যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি দিওয়ানে হাফিজ, কাব্যে আমপারা, রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম ইত্যাদি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন।
নজরুল ছিলেন আজীবন সৈনিক। কখনো সশরীরে, কখনো লেখনিতে। তাঁর মনে মনস্তত্ত্বে ছিলো একটাই শব্দ স্বাধীনতা। সে নজরুল মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রীর বিকলতায় পরাধীনতার মাঝে মুষড়ে পড়লেন। হারিয়ে ফেলেন চেতনা এবং বাকশক্তি, লেখার শক্তিও অল্পদিনে হারিয়ে গেছে। ধীরেধীরে মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালে কবি প্রতিভার মৃত্যু হলেও কবির রুগ্ন দেহ ছিলেন ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী প্রিয় নজরুলকে। কিন্তু তাঁর চেতনা, দ্রোহ, সাম্যবাদ, মানব প্রেম আজও বিদ্যমান আছে নজরুল রচনাবলীতে। এসব গ্রন্থ পাঠ করলে আমরাও পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রেরণা খুঁজে পাবো।