ডেস্ক রিপোর্ট :
বাজারে সারি সারি বস্তায় সাজানো মিনিকেট চাল। সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, এই নামে কোনও ধান নেই। তবু বাজার ভরা মিনিকেট চালে। দেশীয় বাজারে সবচেয়ে বেশি দামি সেদ্ধ চিকন এই চালের। বাহারি অনেক নামেই বিক্রি হয় এই মিনিকেট চাল। যদিও এটি নিয়ে সরকারি বেসরকারি মহলে রয়েছে নানা সমালোচনা, আপত্তি। অনেকের মতে ইরি জাতের মোটা চালকে মেশিনের সাহায্যে ছেঁটে পলিশ করে বাজারে ছাড়া হয় চিকন চাল হিসেবে, যার নাম দেওয়া হয়েছে মিনিকেট। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আইনগত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
ব্যবসায়ীদের মতে, মিনিকেট নামে ভারতীয় ধানের জাত থেকেই বাংলাদেশে মিনিকেট চাল উৎপাদিত হচ্ছে। এখানে কৃত্রিমতা নাই। মেশিনে চাল ভেঙে চিকন করা যায় না। কাজেই অভিযোগ ভিত্তিহীন। মিনিকেট চাল বিক্রির অভিযোগে ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেওয়া হবে অন্যায়। তাদের দাবি, যে মেশিনে মোটা চাল চিকন করে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে সেই মেশিনটি কোথায় কোথায় আছে? কারা বসিয়েছেন? সরকার নিশ্চয়ই তা জানে। কেন সেই মেশিনগুলো জব্দ করা হচ্ছে না? আর যারা মেশিন বসিয়েছেন তাদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না?
অপরদিকে সরকার বলছে, মোটা চালকে চিকন করে বেশি দামে বিক্রি করা ক্রেতাদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাজারে মিনিকেট নামে কোনও চাল বিক্রি করা যাবে না। বস্তায় লিখতে হবে ধানের জাত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মিনিকেট চাল বিক্রির অভিযোগে বিভিন্ন সুপার শপে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে হাজার হাজার বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হলেও সেখানে অভিযান পরিচালনা করছে না।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহম্মদ শফিকুজ্জামান বলেছেন, জনবলের অভাবে এটি করা যাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও মিনিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। মিনিকেট নামে কোনও চাল নেই। তাই চালের বস্তার গায়ে মিনিকেট লেখা যাবে না। ধানের জাতের নাম লিখতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে মিনিকেট ও নাজিরশাইল বলে কোনও ধান নেই। তাই এসব নামে চাল বিক্রি অবৈধ। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। অন্যদিকে, নতুন নতুন কোম্পানি মিনিকেট ও নাজিরশাইলের প্যাকেট করে চড়া দামে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বয়ং কৃষিমন্ত্রী। অন্য যেকোনও চালের তুলনায় মিনিকেট বা নাজিরশাইল কিছুটা চিকন, রঙও ফর্সা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত চালের একটি মিনিকেট চাল, দামও বেশি। অথচ এই নামে কোনও ধানই নেই।
সরকারি সূত্র জানায়, কেবল বাংলাদেশেই নয়, ভারতসহ উপমহাদেশের কোথাও মিনিকেট নামে কোনও ধানের জাত নেই। অর্থাৎ যে জাতের ধানটি বিপুল পরিমাণে চাষ হচ্ছে তা মূলত ভারতীয় শতাব্দী জাত। কিছু ক্ষেত্রে জিরাশাইল ধানকেও মিনিকেট হিসেবে ডাকা হয়। মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজললতা চাল আছে কিন্তু ধান নেই।
তবে সরকার এমন কথা বললেও কৃষকের কাছে ‘মিনিকেট’ একটি আলাদা ধানের নাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিনিকেট’ নামের ধানের ছড়াছড়ি দেখা যায় যশোর অঞ্চলে। ‘ন্যাড়া মিনিকেট’, ‘জিরা মিনিকেট’, ‘সুপার মিনিকেট’, ‘পাঞ্জাব মিনিকেট’, ‘বাসমতি মিনিকেট’নামেও ধানের জাত আছে এই এলাকায়। যশোর অঞ্চলের মাঠজুড়ে ‘মিনিকেটেরই’ ছড়াছড়ি। বোরো মৌসুমে শুধু যশোর নয়, বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার কৃষকরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে কেবল ‘মিনিকেট’ ধানেরই চাষ করেছে।
কিন্তু এই ‘মিনিকেট’ ধানের কোনও বৈধ অনুমোদন নেই বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এবং খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। ভালো ফলনের আশায় কৃষকরা অনুমোদনহীন ভারতীয় এই ধানের চাষ করছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নব্বইয়ের দশকে ভারত থেকে অবৈধভাবে ‘মিনিকেট’ নামের ধানের বীজের আগমন ঘটে বাংলাদেশে। এখন পাঞ্জাব থেকেও এই ধানের বীজ কৃষকরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংগ্রহ করছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকেও নানা জাতের ‘মিনিকেট’ আসছে। আর এর ধাক্কায় দেশি ধানবীজ হেরে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, যশোর সদর উপজেলায় এ বছর ২৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। কিন্তু এরমধ্যে ‘মিনিকেট’ নামধারী ধানেরই চাষ হয়েছে ১০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এলাকায় মোট জমির ৮০ শতাংশেই ‘মিনিকেট’ নামের ধানের চাষ হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশে দেশি জাতের ধানের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে সুবর্ণলতা, বিআর-২৮ ও বিআর-৬৩ অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাদামতলী-বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি চাল ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন জানিয়েছেন, সরকারি বক্তব্য সঠিক নয়। মিনিকেট এক জাতের ধানের নাম। যা ভারত থেকে এসেছে। কুষ্টিয়া, নড়াইল, যশোর এলাকায় এই ধানের ব্যাপক চাষ হয়। মেশিনে কেটে চাল চিকন করা যায় না। মিনিকেট আদতেই চিকন চাল। এ নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণার কোনও সুযোগ নাই।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামও জানিয়েছেন, মিনিকেট নামে কোনও চাল বিক্রি করা যাবে না। বুধবার (৫ অক্টোবর) গাজীপুরের বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার বলেছেন, মিনিকেট নামে কোনও চাল বিক্রি করা যাবে না। মিলে চাল বস্তাজাত করার সময় বস্তার ওপরে ধানের জাতের নাম লিখে দিতে হবে। কেউ যদি এর ব্যতিক্রম করেন, সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।