সাহিত্য ডেস্ক :
দূর থেকে চোখে যে দৃশ্য গঠিত হয় তা একপ্রকার বৃক্ষের বাগানের রূপে পুনর্গঠন ঘটে মস্তিস্কে। সবকটা গাছ উচ্চতায় সমান। অন্যান্য রূপও সাদৃশ্যপূর্ণ। ডাল শাখা-প্রশাখাগুলো স্মৃতির অরূপ রেখার স্বভাবে বিশৃঙ্খল সাজানো। দূর থেকে মনে হয় চোখ ফেরানো কঠিন—বাদুড় ঝুলে আছে ডালে ডালে। তাতে এক মনোরম দৃশ্য সুভাসিত হয় চোখের ক্যানভাসে। ঝুলে আছে হাজার হাজার বাদুড়—দূর থেকে তাই মনে হয়। এটা কোনো গুহাও নয়, জনপদও নয়। দূর চোখে একটা আকৃতি এমনভাবে দেওয়া যায়—ঠিক মানুষের মগজের পাত্রের আকৃতির কাছাকাছি—বাদুড় ঝোলা বৃক্ষের বাগানের ঐহিক রূপ।
ঝুলে থাকা বাদুড়গুলো চাইনিজ লিপি একেকটা। চাইনিজ লিপিরূপে চোখে দৃশ্যান্তর হলে—সবটা মিলে হারিয়ে যাওয়া চিঠির এক বিশাল প্রদর্শনীর ক্যানভাস ভেসে ওঠে। অসংখ্য চিঠি তখন অসংখ্য পরিযায়ী পাখি—ওড়ে সারিবদ্ধ আকাশভূমিতে শায়িত মৃত আলোর উষ্ণ লাশের ওপর। চিঠির অস্তিত্ব মগজে ছিল—নিছক কল্পনা বললে ভুল হবে। চিঠিতে ছিল একটাই শব্দ—নকশাল।
দুর্ভিক্ষ ও বন্যাআক্রান্ত মানুষ ভেসে যায় খরস্রোতে—ময়লা আবর্জনা খরকুটো।
সেদিন অন্ধকার রাত ছিল। ডিপটিউবওয়েলের মোটা পাইপ ভরে পানি আসে বৈশাখ মাসে—আজ অন্ধকার রাতে মানুষ আসে রাস্তা ভরে। সবার হাতে একটা করে ছালার বস্তা। সবার সামনে যিনি হাঁটছেন—চওড়া ঢাল বুক, বাঁশের কুরুল নাক, ধানচাল ঝাড়ার কুলো পা পাতা, গজস্কন্ধ, ইস্পাত টনটন সাহসের যে মানুষটা—একমাত্র তাঁর হাতেই কোনো বস্তা নেই। কাঁধে একটি থলেব্যাগ, বগলে ছাতা—
ঠিক গুদামঘর নয়—গুদামঘরের আদলে গড়া। বেড়া চাল—পুরো ঘরটাই ঢেউটিনের। কোনো বারান্দা নেই। ধানের গোলা। বাড়ির অন্যান্য বসতঘরগুলিও ঢেউটিনের—। বাড়ির সামনে শানবাঁধানো বড় পুকুর। গোলাভর্তি ধান। প্রায় হাজার মণ। কিছুক্ষণের মধ্যে শত শত মানুষ এসে বাড়িটা গিলে ফেলে। এ মানুষগুলোর কারো বাড়ি নেই, কারো ঘর নেই, কারো ভাঙাচোরা ছনের ডেরাঘর—কারো কোনো ভূমি নেই। সবার মাঝে যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মিশে আছে—যারা এ শতশত মানুষকে বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে—তাঁরা, তাঁদের প্রায় সবার ঘর আছে, ভূমি আছে, এত বড় গোলা না থাকলেও ধান আছে, পাট আছে, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ আছে। সেদিন তাদের হাতেও কোনো বস্তা ছিল না। মুখে কোনো কথা ছিল না। বাড়িটার চতুর্দিক ঘিরে দাঁড়িয়েছিল প্রত্যেকে নিজেকে আড়াল করে।
কাঁধে থলেব্যাগ বগলে ছাতা নিয়ে তিনি দাঁড়ান গোলাঘরের দরজার সামনে। বাড়ির সবাই চোখমুখহাত বাঁধা উঠোনে জড়ো করা। শত শত মানুষের নেতার নির্দেশে গোলাঘরের দরজা ভেঙে সবাই বাঁধভাঙা স্রোত ঢুকে পড়ে ঘরে। নিমিষে গোলাঘরটি খালি হয়ে যায়। যাদের ধান ছিল না—গোলাঘরের সব ধান চলে যায় তাদের হাতে।
হাটবার। বাজার। গৃহস্থ পাইকার ক্রেতা-বিক্রেতা। সব্জি মহাল। মাছ মহাল। বাঁশ মহাল। পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ মহাল। সকল পণ্য—আলাদা পরিচয়ে—আলাদা জায়গায় জমায়েত। এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নেই যা হাটবারের বাজারে নেই—অন্তত হাটের দিনে। বিকেলে জমে ওঠে বাজার। কেউ কেনে, কেউ বেচে।
ঠিক ভরদুপুর—কাঁধে থলেব্যাগ বগলের ছাতা মাথায় ছড়িয়ে আনিস ভাই ছয় কিলোমিটার হেঁটে আসেন বাজারে। তাঁর কোনো হাটবার নেই। প্রায় প্রতিদিন তিনি আসেন। কোনোদিন হয়তো কৃষি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মিছিল, কোনোদিন হয়তো কৃষকের ওপর হামলা মামলার প্রতিবাদে পথসভা। হাটবারের দিনতো বাজারের উত্তর পাশে তেমাথার মোড়ে ছাতি মাথায় আনিস ভাই দাঁড়িয়ে থাকলেই হয়—ইজারাদার খাজনা আদায়ের ধারে কাছেও ভিড়বে না।
মানুষের সমস্যার শেষ নেই—আঁধারের বরফে ঢেকে যায় জীবন—ছুটে আসেন আনিস ভাই কাঁধে থলেব্যাগ বগলে ছাতা নিয়ে—ভরসার শিকড় সংশয়হীন বাড়ে—আঁকড়ে ধরে ভূমিতল—নিমিষে মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য হয়ে ওঠে কৃষক জেলে কামার কুমার—বাজারে তিন রাস্তার মোড় এক—আনিস ভাই উঠে দাঁড়ান মোড়ের ত্রিকোণ মঞ্চে—মানুষ ও পৃথিবীর জন্ম ও বেড়ে ওঠার ইতিহাস ও গল্প শুনে কেটে যায় লোডশেডিং—ন্যায্যমূল্য ও পাওনার বাল্যশিক্ষার পাঠ নিয়ে ফিরে যায় ঘরে—কচুরিপানা ও দলকলসের ভিড় কেটে কেটে এগোয় আনিস ভাইয়ের ভেলা—অবিশ্রান্ত পিছু সরে আকাশের কালো মেঘ, প্রচল স্রোতে, মাংসাশী খেকশেয়াল—মানুষের আশ্রয়, মুখের খাবার ভূমি দখলের গল্পে—তখন মানুষ আবার নতুন করে মাটিতে পা ফেলে হেঁটে যায় সামনে—লোডশেডিং কেটে গিয়ে বিদ্যুতের তারের ভিতর বয়ে যায় আগুনের স্রোত।
আনিস ভাই রাজনীতি করতেন—খেটেখাওয়া মানুষের লাঠিয়াল ছিলেন—তাঁর বুকের ভিতর ছিল অদ্ভুত একপৃথিবী কলিজা। তাঁর কলিজা অনবরত বিলিয়ে দিতেন—মানুষ সাহসী হয়ে উঠত। আনিস ভাই তিনবেলা শুধু খাবারের বিনিময়ে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বউকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। যে কয়বেলা বাড়িতে থাকবেন সেই কয়বেলা খাবেন ঘুমাবেন—আবার চলে যাবেন মানুষের পাশে।
আনিস ভাইকে অনেকদিন আর দেখা যায় না। এই শহরে মানুষের পাশে ছিল জীবনমরণ। দিনে দিনে চতুর্দিকে মানুষের পরিধি ও বিস্তার ঘটে অভাবনীয়। উপশহর শহরের চরিত্রে হাতপা নাকমুখ বাড়ে। সবদিক বিন্যাসের ইলাস্টিসিটি ঋজুভারে নমন অনবরত। শহরের পথ উপপথ আরো ছড়িয়ে পড়ে, কোনো কোনো গলি সরু থেকে আরো সরু হয়, কোনো কোনোটা আরও প্রশস্ত ফকফকা। দুয়েকটা অট্টালিকা চাপা আস্ফালনে আকাশের দিকে হাত বাড়ানোর আস্পর্দায় অবগুন্ঠনে দাঁড়িয়ে থাকে।
শহরের মুখে ঢুকতেই ঝকমারি ফাস্টফুডের কাচঘর, পাশেই সেঁতসেঁতে পুড়ি সিঙারার মাটির দোকান, হাঁ করে থাকে সারাক্ষণ গরম তেলের কড়াই। এ শহর প্রান্তরের ৯৫% মানুষ তেলেভাজামানুষ। দুই প্রকারের মানুষই এখানে বসবাস করতে দেখা যায়। একপ্রকার বর্ষকালে উজায়া উঠা বৈচা পুটি খৈলশা বেদ্যা মাছ, অন্যপ্রকার দেশের বড় নদীর বোয়ালের জাত। এখানে নির্দয় রক্তপাতের ইতিহাসও আছে। যখনই রক্তপাত হয়েছে—রক্ত হেঁটেছে বহুমতো সরিসৃপ। মাটি খালবিল নদীনালা রাস্তাঘাট পথপ্রান্তর রেলরাইন পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। হেঁটে হেঁটে এখান থেকে সেখানে, এক থেকে অন্য রক্তের সন্ধান দিয়েছে। আনিসুর রহমান এ সকল রক্তবাজীর জাজ্জ্বল্যমান স্বাক্ষী ও নিকটজন। ঝরা রক্ত কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনিসুর রহমানের বংশবিস্তার করিয়েছে নীরব ও সরবে।
মৃদু বাতাসে কচুপাতা নড়ে না যেন ঠিক এর আদলে টলটলে ভয় কাজ করে এ শহরের মানুষের। আনিসুর রহমানের শূন্যতায় এখানকার বাতাসও, রোদ আর জ্যোৎস্নাও সাহস করে না—ঠিক সাহস নয় সাচ্ছন্দবোধ করে না নিজেদের অস্তিত্বে থাকতে। এ প্রান্তরের গুড়ামাছজাত মানুষ সহসাই ক্ষণে ক্ষণে ধন্ধে পড়ে—বিপদের সম্মুখীন হলে—সম্মুখে এসে দাঁড়ায় আনিসুর রহমান—সেই মানুষটি তখন সাহসী হয়ে ওঠে। সেইমতো যেইনা হয়েছে উদ্যত সাহসী, দাঁড়িয়েছে বুক টেনে ঘুরে তাকেই জেল হাজত গুম হত্যার শিকার হতে হয়েছে—কার্যত যে আনিসুর রহমান নেই বা আছে এ প্রকৃত সত্যটি বুঝতে না পারার দোদুল বোঝাপড়ার সংশয়াকুল চেতনার মহা এক চাপ বয়ে বেড়ায় নিরঙ্কুশ এই এলাকার সেই সকল মানুষ যারা সময় সময়ই মুষ্টিবদ্ধ অস্তিত্বে সাহসের সৌন্দর্যে অধিগত হয়েছে। সাহসই সে—যে সাহসের সঞ্চার করে গেছেন তিনি সে সাহস যে সময় সময় উজিয়ে উঠে সবার। সেইমতো শোর উঠে পালোট তোলে ক্ষিপ্র সমুদ্রের ঢেউ। চন্দ্র সূর্যের বদলে এখানে এখন আনিসুর রহমানের আকর্ষণের কারণে সমুদ্র ও নদনদীর জলস্ফীতির বদলে সাহসস্ফীতি ঘটে। প্রকারে এ শহর ও প্রান্তরের মানুষ সহনে অসহনে উড়ে উড়ে জানান দেয় টলটল সাহসী বেলুন অধিকন্তু কখনো-সখনো টলটল ভয় উড়ন্ত বেলুন ফুটে ফুটে যায়—অনেক মতোর মাঝে একমতো যুগপদ টলটল সাহস ও টলটল ভয় যেন স্বামী-স্ত্রী—একত্রেই সমভিব্যাহারে দাম্পত্যগিরী করে বেড়ায়।
একঝাঁক উপসাগরীয় ঢেউ এসে ঢুকে এ শহর প্রান্তরে অতর্কিতে নয় জন্ম অবধি জন্মান্তর পর্যন্ত দেহ থেকে দেহ বেয়ে নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সহজিয়া পথে। একই আদলে গড়া সবকটা ঢেউ—ঢেউঝাড়—টলটল ভয় অবধি। সবকটা ঢেউ রূপান্তরে ঢেউমিছিল—মিছিল—সবকটা মুখও মিছিল—মুখগুলো আলাদা আলাদা—১, ২, ৩, ৪, ৫... ১০০—অথচ ঢেউ—অথচ মিছিল।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মির্জা সাইফুল ইসলাম, ঠিকানা: দারুল মুসাফির ( নিচ তলা ) আব্দুল গণি হেড মাস্টার রোড, সদর, লক্ষ্মীপুর।